Friday, February 7, 2025
No menu items!
Google search engine
HomeUncategorizedস্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ

স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ

সাতক্ষীরা শহরের মুনজিৎপুর এলাকার রথখোলা বিলের মধ্যে ছোট্ট একটি খুপরিতে তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করেন মাজেদুল ও মাসুরা দম্পতি। মাজেদুল সাতক্ষীরা শহরে ভ্যান চালান। তার স্ত্রী শহরের কয়েকটি বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। দুই ছেলের মধ্যে বড়টা কাজ করেন একটি মোটর গ্যারেজে। ছোট ছেলে ও মেয়ে শহরের একটি স্কুলে পড়ালেখা করছে। এটি এ পরিবারের বর্তমান চিত্র।
অথচ কয়েক বছর আগেও মাজেদুল বসবাস করতেন তার পৈতৃক ভিটা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে। সেখানে নিজস্ব ঘরবাড়িসহ কয়েক বিঘা চাষের জমিও ছিল। সেই জমিতে ফসল ফলাতেন কৃষক মাজেদুল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে তাদের সেই জমিতে লোনা পানি প্রবেশ করে। দীর্ঘদিন ওই জমিতে পানি জমে থাকায় ফসল চাষের অনুপযোগী হয়ে যায়। ফলে বেকার হয়ে পড়েন তিনি।
এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প দামে চাষের সব জমি বিক্রি করে পাড়ি জমান শহরে। মূল শহরে জমি কিনতে না পারলেও শহর লাগোয়া বিলের মধ্যে দুই কাঠা জমি কেনেন। ছোট্ট একটি ঘর করে সেখানেই বসবাস করছেন।
জানা গেছে, এ শহরে তাদের মতো আরও অনেক পরিবার রয়েছে যারা কয়েক বছর আগেও সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করতেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিকাজ বা বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র বসতি গড়তে বাধ্য হন।
যারা এলাকা ছাড়তে পারছেন না তাদের বড় একটি অংশ কাজের সন্ধানে বছরের প্রায় সাত মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বল্প মজুরিতে ইটভাটা ও কৃষিজমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। এজন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি কৃষিজমিতে লোনাপানি তুলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষকেও দায়ী করছেন অনেকে।
২০১৯ সালে এ-সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনা করে শ্যামনগরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লোনাপানি প্রবেশের ফলে গত এক দশকে সাতক্ষীরার দুই উপজেলার আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী এবং সুপেয় পানির উৎস স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার পরিবার স্থায়ীভাবে অন্যত্র বসতি গড়েছে।
শুধু তাই নয়, অস্থায়ী কাজের জন্য তিন লক্ষাধিক মানুষ বছরের প্রায় সাত মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটভাটায় অবস্থান করেন। খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করছেন অনেকে। কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজের জন্য অনেকে উত্তরাঞ্চলে যান।
অন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশেও অনেক বাংলাদেশি অবস্থান করছেন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের তালতলা গ্রামের বাসিন্দা মুকুল গাজী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর কয়েকটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লোনাপানি প্রবেশ করে। পরে বাঁধ মেরামত করতে প্রায় ১১ মাস সময় লেগে যায়। দীর্ঘদিন ধরে লোনাপানি থাকার কারণে এখানকার ফসলের জমিতে এখন আর ফসল হয় না। আবার অনেক প্রভাবশালী আছেন যারা কৃষিজমিতে লোনাপানি এনে চিংড়ি চাষ করেন। এসব কারণে এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। এখানে আর আগের মতো ফসল হয় না। বেশিরভাগ জমিই এখন লবণাক্ত। এছাড়া সুপেয় খাবার পানির চরম সংকট।’
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে কৃষিকাজের কোনো সুযোগ নেই। ফলে যারা পারিবারিকভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তারাও এখন কর্মহীন। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।’
কথা হয় একই উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের বাসিন্দা আশিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সিডর, মহাসেন, ফণি, বুলবুল, আম্পান ও সবশেষ ইয়াসের আঘাতে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। গাবুরা ইউনিয়নের একসময়ের অনেক গৃহস্থ পরিবারের জমি ও সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছেন। একের পর এক দুর্যোগে টিকতে না পেরে অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
‘এখানকার মানুষ নিরূপায়। কারণ এখানে চারদিকে পানি থাকলেও এক কলস সুপেয় খাবার পানি পাওয়া যায় না। মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করতে হয়। গোসলসহ নিত্যকাজের জন্যও লোনাপানি ব্যবহার করতে হয়। এখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত। লোনাপানি ব্যবহারের কারণে এখানকার নারীরা অল্প বয়সে জরায়ু ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন’, যোগ করেন তিনি।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকা। এ ইউনিয়নের চারপাশে নদী। দুর্যোগ এলেই এখানকার মানুষ আতঙ্কে থাকেন। শুধু বাঁধ না থাকার কারণে ইউনিয়নের অনেক মানুষ অন্য এলাকায় বসবাস করছেন।’
স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি এখানে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে আমার ইউনিয়ন কিছুটা হলেও দুর্যোগ থেকে ঝুঁকিমুক্ত হবে।
শ্যামনগরের একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত উন্নয়নকর্মী গাজী আল ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়া, সুন্দরবন ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে স্থানীয় মানুষের প্রবেশাধিকার বন্ধ হওয়ায় মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলেছেন। এসব কারণে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলের মানুষ কাজের খোঁজে স্থানান্তরিত হচ্ছেন।
সাতক্ষীরার এসব জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দুষছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল।
স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু ফান্ডের অর্থায়নে এখনো এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বড় ধরনের কোনো প্রকল্পই নেওয়া করা হয়নি।
সংকট নিরসনে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মোহন কুমার মণ্ডল বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধান ও শাকসবজি চাষাবাদ সম্প্রসারণের পাশাপাশি এ অঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে এখান থেকে আরও অনেক মানুষ স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে।
স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ
তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবির সঙ্গে একমত নয় স্থানীয় প্রশাসন। এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সংকট দূরীকরণ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নতুন করে বেশকিছু সাইক্লোন শেল্টার ও মুজিব কেল্লা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এরই মধ্যে ওই এলাকার একটি অংশে কাজ শুরু হয়েছে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হলে গাবুরার চিত্র বদলে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার মানুষদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আগামীতে এসব কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments